Dhaka, বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪

সামিটের হাতে জিম্মি বাংলাদেশের ইন্টারনেট খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৫ অক্টোবর, ২০২৪, ০৮:০৬ এএম
Bangla Today News

বাংলাদেশের ইন্টারনেট খাতে সামিট গ্রুপের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সব বন্দোবস্ত করেছিল আওয়ামী লীগের সাবেক সরকার। দেশের চাহিদার অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যান্ডউইথের সরবরাহ থাকার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০২২ সালে সামিটসহ তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্স। 

গ্রাহক পর্যায়ে যেতে প্রতিটি ধাপেই সামিটকে লাইসেন্স দিয়ে এই খাতে একচেটিয়া আধিপত্য দেওয়া হয়েছে, যা এই খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ খাতের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কোনোরকম নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট/ব্যান্ডউইথ দিচ্ছে কারা?

জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দুইভাবে সংযুক্ত। একটি হলো সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে, অপরটি ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবলের (আইটিসি) মাধ্যমে।

সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করছে বিএসসিপিএলসি, যা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে সরকারেরই একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। বিএসসিপিএলসি তাদের কার্যক্রম শুরু করে সিমিউই-৪ ক্যাবলের মাধ্যমে, যা কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে বিএসসিপিএলসি যুক্ত হয় সিমিউই-৫ ক্যাবলে, যা কুয়াকাটা থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এই দুই ক্যাবলের মাধ্যমে বিএসসিপিএলসি বর্তমানে প্রায় ৭০০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতা রাখে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠানও বিএসসিপিএলসি। একে সরকারের অলঙ্কার হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

 

বিএসসিপিএলসির এক কর্মকর্তা জানান, সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যাকআপ হিসেবে ২০১২ সালে ৬টি এবং ২০১৪ সালে ১টি, অর্থাৎ মোট ৭টি প্রতিষ্ঠানকে আইটিসি লাইসেন্স দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ব্যান্ডউইথ আমদানির সুযোগ করে দেওয়া হয়। সাবমেরিন ক্যাবল ক্ষতির সম্মুখীন হলে ইন্টারনেট সেবা যেন বিঘ্ন না হয় সেই উদ্দেশ্য থেকে শুধুমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এই আমদানি চালু করা হয়। তখন শুধু সিমিউই-৪ সাবমেরিন ক্যাবল চালু ছিল এবং একটি ক্যাবল যে কোনো সময়ই যে কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন আশঙ্কায় আইটিসি লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। 

সাবমেরিন ক্যাবল ও আইটিসি কে, কত ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করছে? 

বিএসসিপিএলসি কর্মকর্তারা জানান, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের কথা থাকলেও, ব্যাকআপ হিসেবে চালু হওয়া আইটিসিই মূলত দেশের ব্যান্ডউইথ সরবরাহের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি বাড়তে থাকে। এর একটি বড় কারণ হলো, বেসরকারি অপারেটরদের সাবমেরিন ক্যাবলের মতো বিশাল কাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়নি। শুধু অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কম খরচে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সুবিধা পাওয়া গেছে, যা সাবমেরিন ক্যাবলের তুলনায় কিছুটা কম মূল্যে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও গুণগত মান বিবেচনায় ভারত থেকে আমদানিকৃত ব্যান্ডউইথ সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইথ অপেক্ষা নিম্নমানের ছিল। 

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হয় ৬২০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে বিএসসিপিএলসি সরবরাহ করছে ২৯০০ জিবিপিএস। বাকি ৩৩০০ জিবিপিএস সরবরাহ করছে বাকি ৭টি আইটিসি অপারেটর, যার মধ্যে সামিট সরবরাহ করছে ২৫০০ জিবিপিএস।

 

বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্সের আবেদন থেকে শুরু করে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন বিএসসিপিএলসির সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বেসরকারি খাতে এই ব্যবসা চালুর অন্যতম ক্রীড়নক তিনি।

মশিউর রহমান ২০২২ সালে বিএসসিপিএলসি থেকে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরে ফেরত যান এবং একই বছর তিনি প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সিডিনেটের সিইও পদে যোগদান করেন। 

জানা যায়, মশিউর রহমান বিএসসিপিএলসিতে থাকা অবস্থাতেই সামিটের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। তার মেয়াদকালে সিমিউই-৪ প্রকল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমোদন করতে চাননি, যা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান এসে প্রায় ৩৮০০ জিবিপিএস বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু তাই নয় চার বছরেরও অধিক সময় বিএসসিপিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থাকায় কোম্পানির অনেক স্পর্শকাতর তথ্য তিনি তার বর্তমান প্রতিষ্ঠানসহ অন্য দুইটি প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর মেটাকোর ও সামিটের কাছে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

কেপিআইয়ের জায়গা এবং ডাক্ট লিজ নিয়েও বিতর্ক

চলতি বছরের ২৪ জুলাই বিএসসিপিএলসির কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে জমি এবং পিভিসি ডাক্ট লিজ চেয়ে চিঠি পাঠায় প্রাইভেট তিন সাবমেরিন ক্যাবল প্রতিষ্ঠান। পিভিসি ডাক্টের তথ্য তাদেরকে কোম্পানির অভ্যন্তর থেকে সরবরাহ করার অভিযোগ উঠেছে। 

সেই চিঠি যাচাই বাছাই না করেই বিএসসিপিএলসির ৩১ জুলাই এর ২২৮ তম পর্ষদ সভায় উত্থাপন করা হয়। 

পরিচালনা পর্ষদের একজন সাবেক পরিচালককে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, বিষয়টি উত্থাপন করায় বর্তমান সচিব অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন এবং কার স্বার্থে এটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে এ বিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।   

বেসরকারি খাতে লাইসেন্স প্রদানে বিটিআরসির ভূমিকা

চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যান্ডউইথের যোগান থাকা সত্ত্বেও মূলত সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডকে সুবিধা দিতেই বিটিআরসিকে হাসিনা সরকার বাধ্য করে বেসরকারি খাতে সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্স প্রদানে। এর ফলে সামিট আইটিসি, সাবমেরিন ক্যাবল, আইআইজি এবং এনটিটিএন এর ওপর একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রাহক পর্যায়ে যেতে প্রতিটি ধাপেই সামিটকে লাইসেন্স দিয়ে এই খাতে একচেটিয়া আধিপত্য দেওয়া হয়েছে, যা এই খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। 

তারা জানান, সামিটের হাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করে, সেবার মান প্রভাবিত করে গ্রাহকদের জিম্মি করে নিজের সুবিধা মতো ব্যবসা চালাবে। এমনকি এই খাতে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রবেশের সুযোগও সীমিত হয়ে যাবে। 

তাছাড়া দেশের পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিগত সরকারের মদদপুষ্ট প্রতিষ্ঠানের  একক আধিপত্যে থাকায় যেকোনো মুহূর্তে পুরো ইন্টারনেট অচল করে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।

বিএসসিপিএললিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নিজস্ব শতভাগ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এবং আরো একটি সরকারি সাবমেরিন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় বেসরকারি খাতে এই লাইসেন্স প্রদান অনেকটা আত্মহত্যারই শামিল। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাবে, অন্যদিকে ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক দেশের জনগণও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান বিএসসিপিএলসি। এই কোম্পানিকে সরকারের কোনো ভুর্তুকি দিতে হয় না। কিন্তু প্রাইভেটে লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এর পরিণতি টেলিটক ও বিটিসিএলের মতোই হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

Leave a comment