একটা গল্প বলি। গল্পের নায়কের নাম জঁ ইউজিন পল কে (Jean Eugene Paul Kay), ২৮ বছর বয়সী এক ফরাসি যুবক। সময় ১৯৭১ সনের ডিসেম্বরের তিন তারিখ। স্থান ওরলি এয়ারপোর্ট, প্যারিস। অঁদ্রে মালরো হলেন এই গল্পের একটি পার্শ্ব চরিত্র।
প্যারিসের দিকে তখন সকল বড় বড় সংবাদ মাধ্যমের নজর, কেননা তিন তারিখ প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসছেন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সাথে। প্যারিসের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সকলেরও মুল মনোযোগটা ছিল ঐদিকেই। সেদিনই সকাল বেলা এগারোটার একটু পর পাকিস্তানি এয়ারলাইন পিআইএর একটি প্লেনে উঠে পড়েছে এক ফরাসি যুবক। প্লেনটি যাচ্ছিল লন্ডন থকে প্যারিস, রোম, কায়রো হয়ে করাচী- প্যারিসে থেমেছে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ফরাসি যুবক প্লেনে উঠেই সোজা চলে গেছে প্লেনের ককপিটে, হাতে ছোট একটা নাইন এমম পিস্তল, পিঠে ঝুলানো ব্যাগ।
এই যুবকই আমাদের নায়ক- জঁ ইউজিন পল কে। ককপিটে গিয়েই জঁ পিস্তল উঁচিয়ে বলল, এই প্লেনটা আমি হাইজ্যাক করলাম, এখন থেকে আমি যা বলবো ঠিক সেটাই করবেন আপনারা, আমার কথা না শুনলে আমি বোমা দিয়ে প্লেন উড়িয়ে দিব। যুবকের হাতে পিস্তল, কাঁধে ব্যাগ, বলছে বোমা মারবে, পাইলট আর কি করবে- হাইজ্যাকারের কথামতো পাইলটরা ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে এরাপরত কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রোলকে জানানো হয়েছে যে প্লেন হাইজ্যাক হয়েছে। হাইজ্যাকারের দাবী কি? না, হাইজ্যাকারের দাবী খুব জটিল কিছু না, এই প্লেনে বিষ টন ওষুধ আর চিকিৎসা সামগ্রী তুলতে হবে।
(২)
হাইজ্যাকার এতো ওষুধ দিয়ে কি করবে? কোথায় নিয়ে যাবে এতো ওষুধপত্র? বিশ টন ওষুধ আর চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে যেতে হবে কোলকাতায়, সেখান থেকে এগুলি যাবে বাঙালীদের জন্যে যারা এই মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে স্বাধীনতার জন্যে, যাদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। ওষুধ যাবে সেইসব অসুস্থ শিশুদের জন্যে যারা নানা অসুখ বিশুখে ভুগছে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। কন্ট্রোল টাওয়ারে ফরাসি সরকারের লোক এসেছে, ওরা জঁএর সাথে নানারিকম আলাপ আলোচনা করছে, দরকষাকষির চেষ্টা করছে, কোনোভাবে ওকে নিবৃত করা যায় কিনা। না, জঁ ওঁর দাবী থেকে একটুও সরবে না।
হাইজ্যাকের খবর ততক্ষণে প্যারিসে চাউর হয়ে গেছে, সকলে জেনেছে হাইজ্যাকারের দাবী। প্যারিসবাসী সবাই দেখা গেল যে হাইজ্যাকারকেই সমর্থন করছে। ওরলি এয়ারপোর্টের সামনে, পাশে, পেছনে সবদিকে এসে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। প্যারিসবাসীরা যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ এইসবে পাকা সেকথা তো আর আপনাকে আলাদা করে বলে বুঝাতে হবে না। দেখা গেল যে এয়ারপোর্টের আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষেরা সকলে যুদ্ধবিরোধী শ্লোগান দিচ্ছে, শান্তির গান গাইছে, বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে শ্লোগান দিচ্ছে। খবর তো ফরাসি প্রেসিডেন্টের কাছেও গিয়ে পৌঁছেছে, তিনি জার্মান চ্যান্সেলরের সাথে মিটিং বাতিল করে দিলেন।
গোটা দিন দরকষাকষি হয়েছে, বিকেলের দিকে গিয়ে ফরাসি সরকার শেষমেশ আপসরফা করে জঁএর দাবী মেনে নিয়েছে- রেডক্রিসেন্টের মাধ্যমে ওরা ওষুধপত্র পাঠাবে, তবে বিশটন এখুনি পাঠানো যাবে না, এখন একটন পাঠানো হবে, পরে আরেকটা প্লেনে করে বাকি উনিশ টন উশুধ পাঠানো হবে। ঠিক আছে, সেটাই মেনে নিয়েছে জঁ। ওষুধপত্রের চালান এসে পৌঁছেছে, বাক্স বাক্স ওষুধ উঠছে প্লেনে, সাজানো হচ্ছে থরে থরে। কয়েকজন ভনাটিয়ার এসেছে ওরা ওষুধ তুলছে, জঁ নিজেও প্লেনে ওষুধের বাক্স সাজিয়ে রাখছে। ঐ ভলান্টিয়ারদের মধ্যে কয়েকজন ছিল ছদ্মবেশী পুলিশ। ওরা সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে ওকে ধরা যায়।
(৪)
ছদ্মবেশী পুলিশদের মধ্যে দুইজন একটা বাক্স নিয়ে জঁকে দিয়েছে, এই যে ভাই ধরেন এটা। বেশ ভাঁড়ি বাক্স, দুই হাত দিয়ে ধরবে বলে ওর হাত থেকে পিস্তলটা পকেটে রেখে যেই না বাক্স ধরেছে, দুই পুলিশ জাপটে ধরেছে জঁকে। জঁ সহজে হার মানার পাত্র নয়, বাক্স ফেলে সে পিস্তল বেড় করার চেষ্টা করে, দুইটা ঘুষিও মেরেছে পুলিশকে। কিন্তু পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিতে ওর পিস্তল হাতছাড়া হয়ে যায়, ওরা জঁকে পরাস্ত করে ফেলে। গ্রেফতার করে ওকে নিয়ে গেছে ওরলি থানায়। সেখানে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওর ব্যাগটি পরীক্ষা করে দেখা গেল যে সেটাতে কোন বোমা নেই, কেবল কিছু তার, কয়েকটা বই আর টুকটাক এটা সেটা।
সেই সময় টেলিভিশন এতো উন্নত ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, খবর ছড়াতে একটু সময় লাগতো। ঐ রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমেই এই খবরটা বিশ্বব্যাপী ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগলো না। প্যারিসের সর্বত্র তো বটেই, প্যারিসের বাইরেও ফ্রান্সের সর্বত্র এবং বিশ্বের আরো কয়েকটা জায়গায় তখন যুদ্ধবিরোধী মানুষজন সকলে রাস্তায় নেমে গেছে- সকলেই জঁকে সমর্থন করছে, ওঁর মুক্তি চাইছে। ওরলি থানাটিও চারপাশ থেকেই ঘিরে রেখেছে হাজার হাজার মানুষ- সকলেই দাবী করছে যে হাইজ্যাকারকে এক্ষুনি মুক্তি দিতে হবে, বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা এক্ষুনি বন্ধ করতে হবে, ফ্রান্সকে বাঙলার মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
জঁ ইউজিন পল কের হাইজ্যাক চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়- জঁ নিজে পুলিশের হাতে বন্দী। পুলিশ ওকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার সাথে আর কে আছে? না, ওর সাথে আর কেউ নেই। ওর কি কোন সংগঠন আছে? না, ওর কোন সংগঠন নেই। কেউ কি বলেছে তোমাকে এই কাজ করতে? না, ওকে কেউ নির্দেশ দেয়নি। তাইলে তুমি কেন এই কাজ করতে গেলে? কে তোমাকে অনুপ্রাণিত করেছে? জঁ পুলিশকে জানিয়েছে, আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে অঁদ্রে মালরো। কিভাবে? অঁদ্রে মালরো কিভাবে জঁকে অনুপ্রাণিত করেছে সেটা আপনারা জানেন। অঁদ্রে মালরো তখন একটা স্টেটমেন্টে বলেছিলেন যে পাকিস্তান যা করছে বাঙালীদের সাথে সেটা অন্যায়, তিনি বাঙালীদের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করতে চান।
(৫)
ফরাসি সরকার ঘটনাটা নিয়ে জঁএর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, সেই মামলায় ওর তিন বছরের সাজা হয়, তবে পরবর্তীতে সেটা কমিয়ে দুই বছর করা হয়। ফরাসি সরকার কিন্তু ওদের কোথা রেখেছিল- ওরা ঠিকই বিশ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছিল আমাদের জন্যে। সেগুলি এসে যখন আমাদের কাছে পৌঁছেছে তার এক সপ্তাহ পর যুদ্ধ শেষ হয়, পাকিস্তানের মিলিটারি জেনারেলরা আমাদের কাছে মাথা হেঁট করে আত্মসমর্পণ করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ, লাল সবুজ পতাকা, আমার সোনার বাঙলা গেয়ে কান্নার স্বাধীনতা। মাঝে মাঝে আমাদের মনে থাকে না, বিশ্বজুড়ে কতো মানুষ কতভাবে লড়েছে।