নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৯:৩৯ পিএম
কখনও লাফাচ্ছেন, কখনও দৌড়াচ্ছেন; আবার কখনও চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন। বলছেন আজগুবি সব কথা, দিচ্ছেন নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য। ‘বাংলাদেশ থাকবে না। থাকবে না বাংলাদেশ। আজ আমি চিৎকার করব না। আমি রেগে কোনো কথা বলব না। আমি অভিমান করেছি। আমি শোকাহত’- এমন অসংখ্য উদ্ভট কথার মাধ্যমে অনবরত বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজবের জন্ম দিয়ে চলেছেন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলার সিনিয়র এডিটর ও হেড অব ইনপুট হিসেবে কর্মরত ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ।
শুধু তিনি নন, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম এক হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন সেটি অত্যন্ত ‘সুপরিকল্পিত’। বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, ‘রিপাবলিক বাংলা’ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। চ্যানেলটি অনবরত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
একই সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, রিপাবলিক, আজতাক, এবিপি আনন্দসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। এসব চ্যানেলে গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে করা বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। এসব গুজব ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়ানো হচ্ছে।
সম্প্রতি স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ‘রিউমার স্ক্যানার’ ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে অসত্য ও ভুয়া খবর প্রচারের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যেখানে গত আগস্ট মাসের ১২ তারিখ থেকে ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত ১৩টি বিষয়ে ৪৯টি গুজব ছড়ানোর তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
রিউমার স্ক্যানার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে একের পর এক গুজব। রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া গেছে। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক পাঁচটি গুজব প্রচার করেছে। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট। তারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি করে গুজব প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, এসব গুজবের মধ্যে ছিল- শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিও হিন্দু ব্যক্তি হিসেবে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব, বাংলাদেশে মুসলমানদের হামলায় মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর— এমন দাবি প্রতিষ্ঠা করতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে- যুক্তরাজ্যের এমন ভ্রমণ সতর্কতা জারির মতো বিভ্রান্তিকর খবর।
পণ্যবোঝাই জাহাজকে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বলে প্রচার
১৯৭১ সালের পর গত ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে পাকিস্তানি জাহাজটিকে বাংলাদেশে আসার বিষয়ে নেতিবাচক খবর উপস্থাপন করে। তারা এটিকে বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, পণ্যবোঝাই জাহাজকে পুরোদস্তুর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বানিয়ে দেয়। রঙ্গরসে পটু ভারতীয় সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন নানা কল্পকাহিনি ঢালাওভাবে প্রচার করেন।
নিউজ ১৮ বাংলা নামের একটি ভারতীয় গণমাধ্যম এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল- ‘পাকিস্তান থেকে অস্ত্র কিনছে বাংলাদেশ! ৫২ বছর পর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ পৌঁছাল চট্টগ্রামে’। এ বিষয়ে আজতাক নামের আরেকটি গণমাধ্যমের করা রিপোর্টের শিরোনাম দেওয়া হয়, “বাংলাদেশে আসা পাক জাহাজ দেখতে গিয়ে ‘গুম’ কয়েকজন অফিসার! অস্ত্র ছিল?”
রিপাবলিক বাংলার রিপোর্টের শিরোনামে বলা হয়, ‘এক জাহাজ অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ? মৌলবাদের ষোলকলা পূর্ণ হলো বাংলাদেশে?’
কলকাতা নিউজের রিপোর্টের শিরোনামে বলা হয়, ‘পাক-বাংলাদেশের নয়া ছক! করাচি থেকে চট্টগ্রামে পণ্যবাহী জাহাজের আড়ালে অস্ত্র’।
শুধু জাহাজ আসার খবর নয় বরং জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান, পালিয়েছেন ড. ইউনূস, মৌলবাদীদের ভয়ংকর রূপ, সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ অসংখ্য বিষয়ে অসত্য তথ্যের সমন্বয়ে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো।
পাকিস্তান থেকে আসা সেই জাহাজে আসলে যা ছিল
চট্টগ্রাম বন্দরের শিপিং ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া কনটেইনারে ছিল শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য। তালিকা অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে জাহাজটিতে করে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। মোট ১১৫টি কনটেইনারে আসে সোডা অ্যাশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য হলো- খনিজ পদার্থ ডলোমাইট। ডলোমাইট ছিল ৪৬টি কনটেইনারে। ৩৫টি একক কনটেইনারে আনা হয় চুনাপাথর। ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট আনা হয় ছয়টি কনটেইনারে।
এ ছাড়া কাচ-শিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ আনা হয় ১০টি কনটেইনারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক-শিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও রং ইত্যাদি আনা হয় ২৮টি কনটেইনারে। একটি কনটেইনারে ছিল গাড়ির যন্ত্রাংশ। এসব পণ্য আমদানি করে আকিজ গ্লাস কারখানা, নাসির ফ্লোট গ্লাস, প্যাসিফিক জিনস, এক্স সিরামিকস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
শিল্পের কাঁচামাল ছাড়াও পেঁয়াজ আনা হয় ৪২টি একক কনটেইনারে, পরিমাণ ৬১১ টন। এর বাইরে ১৪টি একক কনটেইনারে আলু আনা হয় ২০৩ টন। ঢাকার হাফিজ কর্পোরেশন, এম আর ট্রেডিংস এবং চট্টগ্রামের আল্লাহর রহমত স্টোর পেঁয়াজ ও আলু আমদানি করে।
এসব পণ্যের মোট ওজন ছিল ছয় হাজার ৩৩৭ টন। পাকিস্তানের ১৮টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য সরবরাহ করে।
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতেও ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা
সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনি রং মাখিয়ে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে কোনো কমতি রাখেনি ভারতীয় গণমাধ্যম।
‘মহিলারা শাখা-সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না, হিন্দু বুঝে গেলে সমস্যা বাংলাদেশে’- এমন শিরোনামে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম এবিপি আনন্দ। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নামের একটি মিডিয়ায় সংবাদ হয়েছে, ‘চার মাসে ২০০-এর বেশি হামলা, বিরাট সংকটে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে ইসকনের’।
তবে, এমন কোনো ঘটনার কথা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া সনাতনী মহিলারা শাখা-সিঁদুর পরে বাইরে বেরোতে পারছেন না- এমন অভিযোগও দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন করেনি। উল্টো ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করতে ভারতে যাওয়া হিন্দু নারী ও পর্যটকদের ‘জোর করে’ নির্যাতন করা হচ্ছে- এমন বক্তব্য নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বলছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কথা ভারত বলছে সেটি সত্য নয়।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে প্রশ্ন ভারত তুলেছে, সে ব্যাপারে আমরা লিখিত ও মৌখিক জবাব আগেই দিয়েছি। যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর সুযোগ খুবই কম। সেগুলোর পেছনে ব্যক্তিগত এবং অধিকাংশ ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় কিংবা তারা এটিকে (সংখ্যালঘু নির্যাতন) সমর্থন করছে না। যাদের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম দখলের আবদার সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জনের
৫ আগস্টের পর থেকে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন ভারতের রিপাবলিক বাংলা টিভির সাংবাদিক ময়ূক রঞ্জন ঘোষ।
অভিযোগ উঠেছে, তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ছড়িয়েছেন এবং এখনও ছড়াচ্ছেন। অবশ্য তার উপস্থাপনার ধরন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করায় নিজ দেশেও তিনি বেশ সমালোচিত। সম্প্রতি রিপাবলিক বাংলা টিভিতে প্রচারিত ‘চট্টগ্রাম আলাদা রাষ্ট্র হবে? মাউন্টব্যাটেন-নেহেরুর ভুল ঠিক করার সময় এসেছে? ভারতের হস্তক্ষেপ জরুরি’- এমন শিরোনামের একটি ভিডিওতে তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার কথা বলেন। যা নেটিজেনদের হাস্যরসের খোরাক হয়েছে।
ওই ভিডিওতে উপস্থাপক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষকে ব্যাপক উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ‘চট্টগ্রাম স্ট্র্যাটিজিক্যালি (কৌশলগতভাবে) বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতলাগোয়া যে অঞ্চল রয়েছে তা হলো চট্টগ্রাম। উত্তরপূর্ব ভারতের এ মুহূর্তে কোনো সমুদ্রপথ নেই। আসাম বা ত্রিপুরায় ভারতীয় পণ্য পরিবহনে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। তাই চট্টগ্রাম যদি ভারতের হয়ে যায় তবে এ পথ অনেকটা কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার যদি ভারতের হয়ে যায় তাহলে বঙ্গোপসাগরে ভারতের যে ডোমিন্যান্স (আধিপত্য), সেটি বাড়বে এবং আমেরিকা ধারেকাছে এগোতে পারবে না। সেন্ট মার্টিন নিক, সেন্ট হেনরি নিক; চট্টগ্রামটা যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায় বা ভারতের হয়ে যায়, তাহলে শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়; গোটা পৃথিবীর যারা বঙ্গোপসাগর দখল করতে চায় তাদের চিন্তার কারণ হয়ে যাবে।’
ময়ূখ রঞ্জন দাবি করেন, ১৯৪৭ সালের দিকে চট্টগ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। তাদের তাড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রামকে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে পরিণত করার চেষ্টা চলেছে। কারণ, এ চট্টগ্রাম থেকে হিন্দুরা বিদ্রোহ শুরু করতে পারে।
তিনি আরও বেশ কয়েকটি ভিডিওতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অনেকগুলো জেলা এবং ঢাকাকেও ভারতের অঙ্গীভূত করা নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী বলে জানান।
রিপাবলিক বাংলার সম্প্রচার বন্ধে হাইকোর্টে রিট
এ ধরনের অসত্য প্রচারণা ‘মিডিয়া আগ্রাসন’ হিসেবে অভিহিত করে দেশের সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী এ বিষয়ে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। নোটিশে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা) ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য সম্প্রচার, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টাসহ বিভিন্ন গুজব ছাড়ানোর অভিযোগে ভারতীয় চ্যানেল রিপাবলিক বাংলার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, কন্টেন্ট নিষিদ্ধ ও ব্লক করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে।
রিটে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইসিটি বিভাগের সচিব এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।
রিট আবেদনে বলা হয়েছে, রিপাবলিক বাংলা একটি ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল। এ চ্যানেল স্যাটেলাইট সম্প্রচারের পাশাপাশি তাদের নিউজ ও কন্টেন্ট ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় চ্যানেলটি নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য সম্প্রচার করছে এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। ভারতীয় এ টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে চট্টগ্রাম বিভাগকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। একই সঙ্গে চ্যানেলটি নিরন্তরভাবে গুজব ছড়িয়ে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, উক্ত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিডিয়া আগ্রাসন চালাচ্ছে। চ্যানেলটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ছাড়া ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলটি বাংলাদেশের জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য সরকারকে অবশ্যই ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের জননিরাপত্তার স্বার্থে ওই বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সব নিউজ ও কনটেন্ট বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নিষিদ্ধ ও ব্লক করে দিতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সব টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ চেয়েও হাইকোর্টে আরেকটি রিট দায়ের করা হয়েছে। অবকাশকালীন ছুটি শেষে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এ রিটের শুনানি হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের নিন্দা ৫৩ বিশিষ্ট নাগরিকের
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডার (অপপ্রচার) নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ৫৩ নাগরিক। এমন অপপ্রচারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। পাশাপাশি তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে অপপ্রচার চালানো গণমাধ্যমগুলোকে ‘ভারতের উগ্র ডানপন্থি শাসক দল বিজেপির স্বার্থরক্ষাকারী’ বলে উল্লেখ করেন নাগরিকেরা। তারা বলেন, ভারত সরকার যখন গণহত্যাকারী পতিত স্বৈরশাসককে নিজেদের আশ্রয়ে রেখেছে, তখন ভারতীয় ‘গদি মিডিয়া’ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ‘কল্পিত ক্র্যাকডাউনের’ গল্প প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। দেখা গেছে, এসব কথিত খবর হয় মিথ্যা, নয়তো বিভ্রান্তিমূলক।
বিবৃতিদাতা নাগরিকেরা মনে করেন, এ অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি করা, মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও জাতীয় পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত করা। ‘বৈচিত্র্য বাংলাদেশের মূল শক্তি’- উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের সব জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামতের মানুষ একত্র হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এতে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন- শহিদুল আলম, মোস্তফা নাজমুল মানসুর, লতিফুল ইসলাম, সুমন রহমান, জিয়া হাসান, মারুফ মল্লিক, বখতিয়ার আহমেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, হাসান আশরাফ, আহমাদ মোস্তফা কামাল, সায়েমা খাতুন, স্বাধীন সেন, সাইমুম পারভেজ, পাভেল পার্থ, বীথি ঘোষ, মাহবুব সুমন, ওমর তারেক চৌধুরী, দেবাশীষ চক্রবর্তী, আ–আল মামুন, সুস্মিতা চক্রবর্তী, মোশরেকা অদিতি হক, আর রাজি, মাহাবুব রাহমান, তুহিন খান, মিছিল খন্দকার, ইসমাইল হোসেন, নাহিদ হাসান, গাজী তানজিয়া, কাজী জেসিন, মৃদুল মাহবুব, ফেরদৌস আরা রুমী, মো. হাবিব জাকারিয়া, শাহতাব সিদ্দিক অনিক, ইমরুল হাসান, শাহনাজ মুন্নী, সালাহ উদ্দিন শুভ্র, মিশায়েল আজিজ, সৈয়দ মুনতাসির রিদওয়ান, পারভেজ আলম, আরিফ রহমান, মোহাম্মদ রোমেল, কামরুল আহসান, জিয়া হাশান, আলতাফ শাহনেওয়াজ, শরত চৌধুরী, বায়েজিদ বোস্তামী, পার্থিব রাশেদ, দীপক কুমার গোস্বামী, জি এইচ হাবিব, আবুল কালাম আল আজাদ, আলমগীর স্বপন, সারোয়ার তুষার ও এহসান মাহমুদ।
এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় গণমাধ্যমের এমন অপপ্রচার উভয় দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা প্রয়োজন। কেননা, এ পরিস্থিতি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
কূটনৈতিকভাবে কড়া বার্তা দেওয়া প্রয়োজন : অধ্যাপক রুহুল আমীন
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডাকে ‘মিডিয়া সন্ত্রাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ রুহুল আমীন।
তিনি বলেন, ভারত যা করেছে এটি সম্পূর্ণভাবে ‘মিডিয়া সন্ত্রাস’। কারণ, তারা একচেটিয়া এসব কাজ করছে। একই সঙ্গে এসব কর্মকাণ্ড কূটনৈতিকভাবে ও সরকারিভাবে যে মদদপুষ্ট নয়, এটি ভাববার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার ও কূটনীতিকরা খুব চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বলছেন, এখানকার (ভারতের) মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি ফ্রি (স্বাধীন)। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা নিয়েই তারা কাজ করছেন। আমরা তাদেরকে বাধা দিতে পারি না। আবার এটি আনুষ্ঠানিকভাবেও তারা (ভারত) বলছে না। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে এসব বিষয় প্রতীয়মান হচ্ছে।
“কিন্তু বাস্তব কথা হলো, এটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। এটাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় বলা হয় ‘গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা’। এ থিওরি অনুযায়ী, একটা মিথ্যাকে যখন বারবার সত্য বলা হয় তখন তা আসলেই সত্য হিসেবে পরিগণিত হয়। ভারত আন্তর্জাতিক মহলে দেখাতে চাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন নয়। বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরু থেকেই ভারত বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে।”
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘সরকার গঠনের পরই ইসকনসহ হিন্দুদের বিভিন্ন সংগঠন তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। তখন সরকারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ তাদের নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসে। এমনকি আমাদের দেশের মাদ্রাসার ছাত্ররা পর্যন্ত লাইন ধরে দেশের মন্দিরগুলো পাহারা দিয়েছে। অথচ মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সন্ত্রাসী বলা হতো। আমার কথা হচ্ছে, যদি মাদ্রাসার ছাত্ররা সন্ত্রাসী হয় তাহলে তারা কেন এ সুযোগে হিন্দুদের মন্দিরগুলো ভাঙচুর করল না? হিন্দুদের বাড়িঘরগুলো দখল করে নিল না? উল্টো আমরা দেখেছি যে, ধর্মীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হিন্দুদের বাড়িবাড়ি গিয়েছেন।
এমনকি বাংলাদেশে হিন্দুদের অনেক সংগঠনও বলছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন নেই। আমি ঢাকায় থাকি। এখন পর্যন্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঢাকায় দেখিনি।’
‘ইসকনের নেতা চিন্ময় আইনগত মামলায় আটক হয়েছেন। এটা মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ফৌজদারি অপরাধে তিনি আটক হয়েছেন। তার লোকজন আমাদের একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। এগুলো কি কম অপরাধ? কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এসব কথা বলছে না।
“কিন্তু বাস্তব কথা হলো, এটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। এটাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় বলা হয় ‘গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা’। এ থিওরি অনুযায়ী, একটা মিথ্যাকে যখন বারবার সত্য বলা হয় তখন তা আসলেই সত্য হিসেবে পরিগণিত হয়। ভারত আন্তর্জাতিক মহলে দেখাতে চাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন নয়। বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরু থেকেই ভারত বিভিন্নভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে।”
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘সরকার গঠনের পরই ইসকনসহ হিন্দুদের বিভিন্ন সংগঠন তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। তখন সরকারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ তাদের নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসে। এমনকি আমাদের দেশের মাদ্রাসার ছাত্ররা পর্যন্ত লাইন ধরে দেশের মন্দিরগুলো পাহারা দিয়েছে। অথচ মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সন্ত্রাসী বলা হতো। আমার কথা হচ্ছে, যদি মাদ্রাসার ছাত্ররা সন্ত্রাসী হয় তাহলে তারা কেন এ সুযোগে হিন্দুদের মন্দিরগুলো ভাঙচুর করল না? হিন্দুদের বাড়িঘরগুলো দখল করে নিল না? উল্টো আমরা দেখেছি যে, ধর্মীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হিন্দুদের বাড়িবাড়ি গিয়েছেন।
এমনকি বাংলাদেশে হিন্দুদের অনেক সংগঠনও বলছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন নেই। আমি ঢাকায় থাকি। এখন পর্যন্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঢাকায় দেখিনি।’
‘ইসকনের নেতা চিন্ময় আইনগত মামলায় আটক হয়েছেন। এটা মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ফৌজদারি অপরাধে তিনি আটক হয়েছেন। তার লোকজন আমাদের একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। এগুলো কি কম অপরাধ? কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এসব কথা বলছে না।’
ভারতকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া বার্তা পাঠানো প্রয়োজন- জানিয়ে অধ্যাপক রুহুল আমীন বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। উনার বক্তব্য ঠিক আছে। তবে আমি যোগ করতে চাই, উনি (উপদেষ্টা) ভারতকে এত ছাড় দিতে পারেন না। আমাদের এত নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। আমার নাগরিকদের হত্যা করা হবে, তাদের লাশ গুম করা হবে, আর বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠকের নাটক মঞ্চস্থ করবে, তা হতে পারে না।’
বাংলাদেশ ভারতের শাসিত অঞ্চল নয়- উল্লেখ করে এ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘আমি মনে করি, ভারতকে আরও কড়া বার্তা দেওয়া উচিত। শেখ হাসিনা দুই হাজারের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যার মাস্টারমাইন্ড। আর ভারত বলছে, তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে। এটা বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ-ভারত পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। উভয় দেশের স্বার্থগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটাকে ছিন্ন করে আরেকটাকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। ভারত যদি আমাকে আঘাত করে, আমারও উচিত হবে ভারতকে আঘাত করা। ভারত যদি আমাকে ফুল দেয় তাহলে আমিও তাকে ভালোবাসার ফুল দেব। আর ভারত যদি আমাকে আঘাত করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের সংগীত শুনাব না। আমি অবশ্যই তাকে নজরুলের বিদ্রোহ কবিতা উপহার দেব।’
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো অপসাংবাদিকতা করছে : অধ্যাপক মফিজুর রহমান
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার ‘অপসাংবাদিকতা’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান। বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ ইস্যুতে যেসব প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, এগুলো অপসাংবাদিকতা। আর অপসাংবাদিকতা করতে কোনো ভিত্তি লাগে না। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজেদের বানানো ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে সাংবাদিকতা করছে। এগুলো দুটি দেশের সম্পর্ক নষ্ট করবে এবং জনগণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করবে।
তিনি বলেন, ‘সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, সেগুলো যখন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তখন লাখ লাখ মানুষ সেটি বিশ্বাস করে বসে থাকে। এ ছাড়া এগুলো যে মিথ্যা তথ্য সেটি সবাইকে বুঝানো সম্ভব না। কারণ, দুই দেশের মানুষের মধ্যেই মিডিয়া লিটারেসি তেমন নেই। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখি সেটিই বিশ্বাস করে বসে থাকি। সেজন্য বলতে পারি, আপামর সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো সাংঘাতিক রকম নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। যা দুই দেশ এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্কের অনিশ্চয়তা বাড়াবে।
এ ধরনের সাংবাদিকতা দুই দেশের মধ্যকার সুষ্ঠু সম্পর্কে অন্তরায় তৈরি করবে-উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকতার নাম দিয়ে যারা এসব করছে তারা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমন কর্মকাণ্ড দুই দেশের সুষ্ঠু সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায়।’
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্ব কী-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যারা রয়েছেন তারা বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই সামলে নিয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার এরই মধ্যে দেশে ও বিদেশে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলো সত্য তথ্য তুলে ধরছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- মাঠে কী হচ্ছে সেটির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা। আর বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সত্য তথ্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে। আসলে বাংলাদেশে এমন কিছুই হয়নি। আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে বিষয়টি নিয়ে ভালো রিপোর্ট হয়েছে। সার্বিকভাবে আমার মনে হয় যে, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো যে অপতথ্য ও অসত্য তথ্য ছড়িয়েছে, সেটি ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছেছে। গণমাধ্যমগুলোকে সবসময় তাদের পেশাদারিত্ব ধরে রেখে এবং ক্ষমতা কাঠামোর চিন্তা না করে সত্যনির্ভর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে গুজব, অপতথ্য ও অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’
ভারত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছে বাংলাদেশ
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও স্থান পেয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম জসীম উদ্দিন জানিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তিকর বয়ান দেওয়া হচ্ছে। সে বিষয়ে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তী সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান ছড়ানো হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি। সেই সঙ্গে আমরা জোর দিয়ে বলেছি যে, বাংলাদেশে বসবাসরত সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করে আসছে এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালানোর সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের আহ্বান জানিয়েছে। আমরা এ-ও বলেছি যে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়।
‘আমি এটাও বলেছি যে, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত’— মন্তব্য করেন জসীম উদ্দিন।