ওবায়দুল ইসলাম রবি, রাজশাহী
নোয়াখালীতে সেনাবাহিনীর ভুয়া ক্যাপ্টেনসহ আটক ২
কুমিল্লায় বালিকা বিদ্যালয়ের ভর্তির লটারিতে ছেলে, যা বললেন প্রধান শিক্ষিকা
সীমান্তের ওপার থেকে ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল
এক গুচ্ছ অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির নিয়ে বেতার শিল্পিদের অভিযোগ এখন জেলা প্রশাসকের কাছে।
বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালকের (ডিডি) বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। গত প্রায় ১২ বছর যাবত কর্মরত আছেন রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসে পরিচালক পদে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ৫২ জনকে কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। গণহারে নিয়োগ দেওয়া এসব কর্মচারীর বেতন দেওয়া হয়, অনিয়মিত শিল্পীদের বাজেট থেকে।
এসকল অনিয়ম নিয়ে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েয়ে বেতারের নিয়মিত শিল্পীদের মাঝে। তাঁর নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তথ্য উপদেষ্টার কাছে লিখিত ১৬ জন অনিয়মিত শিল্পী অভিযোগ করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কয়েকজন অনিয়িমত শিল্পীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মৌখিকভাবে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁদেরকে বেতারে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজ হারিয়ে এখন সেসব শিল্পী বেকার বসে আছেন। এসব নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন এ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে প্রকৃত শিল্পীরা ঠিকমতো কাজ পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাণ নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন, স্রোতারা হচ্ছেন বিমুখ।
অভিযোগ সূত্রমতে, বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী কেন্দ্রের ডিডি হাসান আক্তার ২০০০ সাল এখানে কর্মরত আছেন। তবে গত ২০১৩ সালে তাঁকে বদলি করা হয় ঠাকুরগাঁ। যেকোন অপায়ে তিনি পূনরাই ২০১৩ সালে ফিরে আসেন রাজশাহীতে। সময়ের ব্যবধানে ২০২০ সালে পদোন্নতি হয় আঞ্চলিক পরিচালক হিসাবে। কিন্ত কর্মস্থল বদল হয়নি। এটিও সরকারি চাকরিবিধিতে বড় ধরনের অনিয়ম বলে দাবি করেছেন এ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বৃন্দ। তবে চলতি বছরের ৬ মে তাঁকে বরিশালে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যোগদান করার আগেই ৬ মে’র আদেশ বাতিল করে নতুন করে ১৩ মে জারিকৃত আরেক আদেশে রাজশাহীতেই বহাল রাখা বর্তমান ডিডিকে। একযুগ ধরে তিনি সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে একই কর্মস্থলে চাকুরী করছেন।
তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের পরিচালক হাসান আক্তার পতিত সেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাজশাহীতে কোনো মন্ত্রী আসলেই তিনি গাড়ী বহর নিয়ে ছুটে চলে যেতেন তদারকিতে। গত ৫ আগস্টের পরেও তিনি এখনো এই কেন্দ্রে বহাল তবিয়তে আছেন। এমনকি ৫ আগস্টের আগে পরিচালক হাসান আক্তারের আস্থাভাজন নিয়মিত শিল্পী রেজাওয়ানুল হুদা খন্দকার রুবেল তার ফেসবুকে ছাত্রজনতার আন্দোলন বিরোধী নানা রকম পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি তাঁকে কুমিল্লা বেতারে বদলি করা হয়। কিন্তু আবারও রুবেলকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন পরিচালক হাসান আক্তার।
হাসান আক্তার বেতারের বিভিন্ন গোষ্ঠি ভিত্তিক বা দলীয় নাটক, যাত্রাপালা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের চুক্তিগুলো নামে-বেনামে করে সেসব অনুষ্ঠানের বরাদ্দকৃত অর্থ নিজেই তুলে নেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন বেতারের প্রধান সহকারী মীর শামসুজ্জোহা ও অফিস সহায়ক সালাউদ্দিন। একাধিক অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার করা হলেও সেগুলো নিয়মিত দেখাইয়ে অর্থ আত্মসাত করেন তাঁরা। এছাড়াও বেতারে প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েও তিনি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করছেন। সবমিলিয়ে গত কয়েক বছরে তিনি অন্তত ৫২ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। যাঁদের বেতন দেওয়া হয় অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে। এতে করে শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থ ব্যয় করার কথা থাকলেও সেটিও হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাণ নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। স্রোতারা হচ্ছেন বিমুখ। একটি অনুষ্ঠান গড়ে এখন বড় জোর দুই-তিনশ স্রোতা রাজশাহী বেতারের অনুষ্ঠান শোনেন। অথচ একসময় ছিল হাজার হাজার।
ওই লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী শাখার কম্পিউটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র মেরামত বা সংস্কার করার নামেও ভুয়া বিল ভাউচারে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়। অথছ কম্পিউটারগুলোর অধিকাংশই বেশিরভাগ সময় সচল থাকে না। পরিচালকের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁদেরকেই হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। কারও কারও অস্থায়ী নিয়োগও বাতিল করা হয়। সম্প্রতি লিখিত অভিযোগ করায় মিউজিশিয়ান শাহেদুজ্জামান খান চপলসহ আটজনকে মৌখিক আদেশে নিয়োগ বাতিল করা হয়। এর মধ্যে ২৮ বছর ধরে চাকরি করতেন শাহেদুজ্জামান চপল।
তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। রাজশাহী বেতারে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ২৮ বছর ধরে সংসার চালায়। কেউ বলতে পারবে না আমি কোনো দল করি। কিন্তু পরিচালকের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষর করায় আমাকে বেতারে যেতে নিষেধ করেছেন তিনি। এর পর থেকে আমি প্রায় দুই মাস ধরে বেকার বসে আছি। এই বয়সে আমি এখন কি করে খাবো। আমি পরিচালককে বলেছিলাম, আমার অপরাধ কি? তিনি কোনো উত্তার দেননি। তিনি উত্তর দিতে পারবেনও না। কারণ তিনি রাজশাহী বেতারকে নিজের ঘর-বাড়িতে পরিণত করেছেন। তাঁর আস্থাভজনদের নিয়ে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড় গড়েছেন। আর যারা প্রতিবাদ করে তাদের তিনি নানাভাবে হয়রানি করেন।’
অভিযোগকারীদের মধ্যে আরেকজন হলেন রাজশাহী বেতারের সঙ্গীত শিল্পী সংস্থা’র সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘ আমি বেতারে আছি প্রায় ৩০ বছর ধরে। আমার নেতৃত্বে দুইবার রাজশাহী বেতারের টিম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। অথচ প্রতিবাদ করায় আমাকেই মৌখিকভাবে ব্ল্যাক লিস্ট করে রেখেছেন পরিচালক। আমাদের কোনো অনুষ্ঠান দেওয়া হচ্ছে না। আমার মতো অনেক শিল্পী এখন কাজ পাচ্ছে না। তাঁদের পরিবারগুলো এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। শুধু পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে।’ রাজশাহী বেতার অনিয়ম-দুর্নীনিতে ঠাসা। আমাদের টাকা ব্যয় করা হয় কর্মচারীদের পেছনে। অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে একেক দপ্তরে দুই-তিনজন অফিস পিয়নও রাখা হয়েছে। নিয়ে আমরা ১৬ জন একটি লিখিত অভিযোগ করেছি। এখন আমাদের চাকরিচ্যূত করা হচ্ছে। চাকরি হারিয়ে আমরা এই বয়সে যাবো কোথায়? অভিযোগে স্বাক্ষরকারী সঙ্গীত শিল্পী হুমায়ন কবির বলেন, অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, এখনো বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। বেতারের আরেকটি সূত্রে জানা যায়, পরিচালক হাসান আখতার অনিয়ম-দুর্নীতি করে রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পত্তি কিনে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। যে ভবন নির্মাণ করতে তার অন্তত ৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেতারের রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক (ডিডি) হাসান আখতার বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ হয়েছে শুনেছি। কিন্তু আমি কোনো অন্যায় বা অনিয়ম করিনি।’ চাকরিচ্যুত সম্পর্কে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে এখন কিছু বলতে পারব না। এখন তিনি বাহিরে কাজে ব্যস্ত আছেন।